অতনু সিংহ কবি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে উঠলেও নিজস্ব ভাষাভঙ্গিমায় তাকে পশ্চিমবঙ্গের নয় বরং তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা ভাষার একজন মেধাবী কবি। অকালবোধন অনলাইন সংস্করণের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘তূণীর’-এ প্রকাশিত হলো কবির একগুচ্ছ কবিতা।
কোরআন অর্থাৎ যা পঠিত হয়
তোমার চিহ্ন ছড়ায়ে আছে আমার সকল ঘরে
আমি পাঠ করি তোমারে এইবার
বসন্ত ফুরায়ে আসার সময়
একটি বিচ্ছিন্ন দুপুরে
আমবাগান হতে বাতাস বইছে,
স্নান সেরে নিতে হবে ব’লে
স্যান্ডেল খুলে রেখে
আমি যাই স্থির ওই জলাশয়ে
আমারে তো তুমিও দ্যাখো
হে আকাশ ও পানির ঈশ্বরী আমার
হে চরাচর, তোমারে মন্ত্রমুগ্ধ পাঠ করি
তুমিও পরখ করো আমায়
তোমার-আমার পাঠোদ্ধারে বসন্তে বারবার
সবুজ হয় বনাঞ্চল, আম্রমুকুলের সুবাস
ছড়ায়ে যায় আমাদের ঘর ও দুয়ারে, প্রতিবেশে,
শান্তিকল্যান গেয়ে ভোরবেলা দুয়ারে দাঁড়ায় ফকির
চিহ্নের জগত বাঙ্ময় হয়
মগ্নচৈতন্যে আমরা গেয়ে উঠি আয়াত,
পাঠ করি ত্রিভূবন…
গোসলের পানি লেগে থাকে আয়নায়!
মক্তব হতে ভেসে আসে পাঠ,
মিছিলে জিন্দাবাদ ধ্বনি…
আমি সর্বত্রই আছি
কারণ প্রেম আমারে পাগল বানায়েছে
তুমিও সর্বত্র কারণ তুমি এই দুনিয়ার দয়ালচাঁন
আমাদের ভরসার মালিক তুমিই
তুমিই এই প্রকৃতি আমার, এই বেলা-অবেলা,
এই কবিতার বাক্যের ভেতর তুমিই রুহু
আর বৃক্ষমালা, জলরাশি, আসমান,
একান্তে আমাদের আয়নামহল…
ক্যাম্প
ধরো চিত্রবহুল
এই সংসার,
তাঁবুর সিনেমা ভোর ভোর
মারেফত হয়ে গেছে
তার নুপূরে
তন্দ্রা ঘনায়
আলো হয় উঠোন
তার নৈঋতে ডাক ওঠে
ডাকচিঠি
আলাপ ছোঁয়ার
তার জানালা আওয়াজ
ছায়াঘর ফিসফিস
বন্দুক রাখা রাজকীয়
সঙ্গীত ওঠে ধরো
খঞ্জনি
সানাই সানাই নহবত
আর চুপচাপ
চিলেকোঠা
ঘুমরাতে যেমন
জলের স্বভাব
তারে পেয়ে যাই
কখনো কখনো মদ ঠিক
মদ নয়, যেন নদী চাঁদে ভরা
গ্লুমি এক পূর্ণিমা থেকে
সে নদী আকাশ হতে
ধেয়ে আসে মাটিতে মাটিতে
আমাদের ঘরে,
আমি তারে পাই
বলিবারে যাই তার কাছে
গ্লুমি ওই চোখের কিনারে
সে আমার মদ হতে নদী হয়ে ওঠে…
সন্তানরে পালে যেমনটিভাবে
তেমনই তো আমার এই আলাপের
বাড়িঘর, ছোট ঘর, আসবাব
ছড়ানো ছেটানো— যদি সে আসে
গ্লুমি এক পূর্ণিমা হয়ে
এই ঘরে মায়াবাতি হয়ে
আতপের জলে একবার
মুখোমুখি তার রঙের আকাশ
পদ্মার পারে
জীবনের গ্লুমি এই রাতের আঁধার
বেজে ওঠে তার ঠোঁটে
আমি তারে পেয়ে যাই একান্তে একবার
একবার জন্মটি যেমন, মৃত্যুও একবার
কড়িখেলা, ভোর
দুয়ারে প্রভাত
জন্মান্তর
জোড়া দিতে গিয়ে টুকরো হয়েছি!
টুকরোটাকরা ছবি, গানের মাধুরী,
শ্বাস, চিরায়তে জামদানি মেঘ,
তাহার নীচেতে এই
ভাসমান ছায়াধোয়া জল,
চৈত্রপবনে কিছু স্মৃতির কাঁপন–
জুড়ে জুড়ে সন্ধ্যা গেঁথেছি
দূর এই শহরের নীরব আঁধার
বাতাসে বাতাসে দ্যাখো উড়ে যায় ছাই
শোনা যায়, এইখানে মানুষেরা
সমুদ্রে হারায়! কাহার দুঃখ নিয়ে
জেগে থাকে দূরের পাহাড়…
এইখানে ছিল ছবি, ছায়া ছায়া
মেলা ও মোচ্ছব…
কীর্তনখোলা পানে
ছিল প্রিয় রাধিকার গান
পুরাণের মালা হয়ে আমাদের
জুড়ে দিতো নদী,
মক্তবে পাঠের আরাম
সুর এক যাপনের অভ্যাস
পানি দিয়ে বাঁধা দ্যাখো থইথই প্রেম
রন্ধনশালে ঝোলে মুক্তির থান
তাহার বুননরেখা পড়ে নিও তুমি
ঘুমের ভেতর রেখে দিও
আমাদের রতিশ্বাস৷
টইটই গত বৈশাখ থেকে আষাঢ়ে আষাঢ়ে
যা ছিল ভিতরে ভিতরে
সেইসব— ‘কী হয় কী হয়!’
যখন একটি সকাল মেখে ঘুমায়ে রয়েছি
টুকরোটাকরা হয়ে
মিশে যাই মাটিতে, ছায়ায়,
রেণুরেণু পল্লবে,
স্নানাগারে পড়ে থাকা আঁশে,
রক্তের ভিতর, নদীতে,
চিরায়তে আলোকরেখায়…
স্বপ্নে পাওয়া
চিন্ময়ী আলোর খেলায় টেলিস্কোপবিহীন
আমি জেনে গেছি এই মহাকাশবিদ্যা।
মহাজাগতিক বন্ধনে আমায়
আগলে রেখেছে কোনো এক গান
আমি ঘুমায়ে ছিলাম জঠরে
আমি জেগে উঠেছি ক্রোধ, কান্না,
অভিশাপ আর অশ্রুর ভিতর,
নিয়েছি যুদ্ধের গোপন প্রস্তুতি!
শরীরে তবু বেজে ওঠে তন্ময়ঘোর
যা ছিল মায়ের পেটের আঁধার
তা এই আকাশে আকাশে চিন্ময়ী আলোকরেখায়–
যখন সব খেলা সাঙ্গ হয়ে যায়,
নিভে যায় ঘর ও বাহির,
সকল বিজলী বাতি, যখন
ডিজিটাল পৃথিবীর গতি শ্লথ হয়ে আসে
দেখি, আমি ন্যাংটো শুয়ে আছি
মিথ হয়ে জেগে থাকা যমুনার ঘাটে,
অথবা পূর্ণিমা বেছানো এক ছাদের মাথায়–
নক্ষত্রেরা ঝরে পড়ছে ফুল আর
রঙ্গিলা সুরের পতঙ্গ হয়ে শরীলে আমার
জন্ম হচ্ছে ভাষার
মাটির ভিতর থেকে জিহ্বায় জেগে উঠছে স্তব
প্রতিটি ভোরে নতুনভাবে
আমি জন্ম নিচ্ছি
কবিতা লিখতে হবে ব’লে
কবি পরিচিতি :
অতনু সিংহ
জন্ম- ২২/০৮/১৯৮২
বাসস্থান- হাওড়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ১/ ‘নেভানো অডিটোরিয়াম (২০০৯ সাল, লালন প্রকাশনী, হাওড়া)
২/ ‘ঈশ্বর ও ভিডিও গেম (২০১৪ সাল, হুডিনির তাঁবু প্রকাশনী, কলকাতা)
৩/ ‘বন-পাহাড় থেকে সে কেনই-বা ফিরবে এ কারখানায়’ (২০১৭ সাল, কবীরা প্রকাশনী, কলকাতা)
৪/ ‘ঘুমের চেয়ে প্রার্থনা শ্রেয়’ (২০১৯, বেহুলা বাংলা প্রকাশনী, ঢাকা)
প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন- ‘অপর লিখিত মোনোলগ ও কয়েকটি প্যারালাল কাট’ (২০১০ সাল, হুডিনির তাঁবু প্রকাশনী, কলকাতা)