রবীন্দ্রনাথ ১৩০২ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘গ্রাম্যসাহিত্য’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘কেবল সম্প্রতি অতি অল্পদিন হইল আধুনিক কাল, দূরদেশাগত নবীন জামাতার মতো নূতন চাল-চলন লইয়া পল্লীর অন্তঃপুরেও প্রবেশ করিয়াছে। গ্রামের মধ্যেও পরিবর্তনের হাত পড়িয়াছ ’। প্রায় একশো বছর পেরিয়ে আজ উন্নত প্রযুক্তির কালেও বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির সেই পরিবর্তনের মাত্রা বেড়েছে বই কমেনি। অতএব এই বিবর্তনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সংহত অঞ্চলের সংস্কৃতিই লোকসংস্কৃতি, যার ক্ষেত্রস্থল মূলত গ্রামাঞ্চলই। বাংলার লোকসংস্কৃতির কথা যদি বলি, তাহলে অবস্থান ও ভৌগোলিক পরিবেশের সাপেক্ষেই তা বিচারযোগ্য। লোকায়ত ভারতবর্ষ, কৃষিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক গ্রামই তো ভারতবর্ষের প্রকৃত স্বরূপ। বাংলা সেই গ্রামীণ ভারতবর্ষের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং বাংলায় যারা উচ্চসংস্কৃতির ধারা বহন করছে, তাদের সেই উচ্চসংস্কৃতির গভীরেই গ্রামীণ অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। তাই পরিশীলিত সংস্কৃতির ধারক ও বাহকগন কখনোই তাদের আদি সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে পারবেন না।
সংস্কৃতি আসলে সুরুচিপূর্ণ এক ধারাবাহিক উৎকর্ষতার চর্চা এবং সংস্কৃতির ধর্মই পরিবর্তনশীলতা। লোকসংস্কৃতিও তার ব্যতিক্রম নয়। সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েই যায়। বর্তমানে বাংলায় লোকসংস্কৃতির পুনরুদ্ধার এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে লোকসংস্কৃতির মিশ্রনে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটেছে লোকসংস্কৃতিতে, যার ফলস্বরূপ এক নবজাগরণের পটভূমি তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ লোকসংস্কৃতির মধ্যেও আধুনিকতার প্রবেশ ঘটেছে নবজাগরণের হাত ধরে, যেভাবে বাংলায় উনিশ শতকে আধুনিকতার আগমন হয়েছিল নবজাগরনের হাত ধরেই। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের মূল ভিত্তি ছিল-
১.প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যার পুনরুদ্ধার।
২.পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পরিগ্রহণ।
রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ এই প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যান। রামমোহন তাঁর ‘বেদান্তগ্রন্থ’, ‘বেদান্তসার’-গ্রন্থে পুরোনো সংস্কৃতিকে নতুনভাবে বিচার করেন বাংলার স্বার্থেই। বিদ্যাসাগরও সংস্কৃতচর্চার পথেই হেঁটেছিলেন। মধুসূদন ভারতীয় পুরাণ সাহিত্যকে পাশ্চাত্যের আলোতে ফেলে তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’, ‘ব্রজাঙ্গণা’ কাব্য নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’-এর কৃষ্ণকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই সাজিয়ে তুলেছিলেন। অতএব প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই বিপরীত বিদ্যাচর্চার পথ ধরেই যেভাবে বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ ঘটেছিল, সেভাবেই প্রযুক্তি তথা বিশ্বায়নের কালে বাংলার লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছে মূলত,
১.লোকসংস্কৃতির পুনরাবর্তন।
২.লোকসংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংযোগ।
এই আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছে অনেকদিন আগেই কিন্তু তার রেশ আজও কাটে নি। বর্তমানে ভার্চুয়াল জগতে সেই আধুনিকতার গতি আরও তরান্বিত হয়েছে, আগামীদিনে আরও হবে এই আশাই করছি।
পৃথিবীর সর্বত্রই নবজাগরণের কেন্দ্রে আছে মূলত তিনটি কথা,
১.ব্যক্তিস্বাতন্ত্র
২.যুক্তি
৩.মানবতা
এখন প্রশ্ন হল, আধুনিকতা কাকে বলবো? আধুনিকতার মাপকাঠিই বা কী? এ প্রসঙ্গ বড় জটিল। জটিলতার শুরু তখনই, যখন ব্যক্তিস্বতন্ত্রতাবোধের উদয় ঘটে। ব্যাক্তিবিশেষে আধুনিকতার সংজ্ঞা ভিন্ন। তবু বাংলার লোকসংস্কৃতির আধুনিকতার মানদণ্ড নির্ধারণের দায় গ্রহণ করে বলতেই পারি, বাঙালির চিরাচরিত আদর্শ অর্থাৎ মঙ্গলসাধনাকে কেন্দ্র করেই লোকসংস্কৃতির অভ্যন্তরে নবজাগরণের অনুসন্ধান করেছি। এ মঙ্গল ব্যক্তি তথা জাতির। সুতরাং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, যুক্তি ও মানবতার মেলবন্ধনে বাংলার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে নবজাগরণের পথ প্রশস্ত হয়েছে,তারই ভাবকল্প প্রতিফলিত হয়েছে বর্তমান প্রবন্ধে।
লোকসংস্কৃতির প্রধান নিদর্শন, লোকসাহিত্য, লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য, লোকশিল্প, লোক-ঔষধ এছাড়াও পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও আধুনিকতার যে প্রসার ঘটেছে, অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনেই সেই ব্যাখ্যায় যাবো।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে যদি দেখি, তাহলে লক্ষ্য করা যাবে মধ্যযুগের সাহিত্যে যে লোকাচার, লোকবিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায়, তা লোকসংস্কৃতিরই নিদর্শন। পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিকতার প্রথম পর্বে লোকসাহিত্যের অগ্রগতিতে সৃষ্টি হয়েছে লোকায়ত সাহিত্য। গ্রামীণ সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি থেকে যখন নগর কলকাতার জন্ম হয় তখন নাগরিক সংস্কৃতির প্রভাবে সৃষ্টি হয় পাঁচালি, কবিগান, আখড়াই ইত্যাদি। আবার লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা, ছড়ার ভাবনায় মুগ্ধ হয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ রচনা করেছিলেন। আরও এগিয়ে যদি দেখি, তাহলে দেখা যাবে, উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ে মহাশ্বেতা দেবী, মানিক বন্দোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার প্রমূখ লেখকদের সাহিত্যের লোকজ উপাদান একরকম নয়, তা অনেক বেশি আধুনিক, মানবিকতার দায় অনেকখানি বহন করেছে। উচ্চসাহিত্যের সাথে লোকসাহিত্যের এই যোগসূত্র চিরকালীন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘নিম্নসাহিত্য এবং উচ্চসাহিত্যের মধ্যে বরাবর ভিতরকার একটি যোগ আছে’। সময়ের সাথে সাথে লোকসমাজে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিক বিচ্ছিন্নতারও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আজও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ লোকসাহিত্যের বিচিত্র বিষয় নিয়ে পুনর্ভাবনা করছে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই। এভাবেই ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যকে শুধুমাত্র সংরক্ষিত না রেখে যেভাবে চর্চা ও গবেষণার অঙ্গীভূত করা হচ্ছে বাংলা তথা বাংলার বাইরেও, তা লোকসাহিত্যে নবজাগরণের পথকেই সুগম করেছে। তবে এই আধুনিকতার যাত্রা অনির্দেশ্য, সময়ের হাতেই তার পরিনাম রচিত হবে।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আধুনিকতার আলো পড়ে সেইসময়, যে সময় রবীন্দ্রনাথ লোকগানের সুর ও দর্শনকে কেন্দ্র করে তাঁর কিছু গান নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে বহু লোকসঙ্গীত শিল্পীর গানেও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাবনার অনুপ্রবেশ পরিলক্ষিত হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পূর্ণদাস বাউল। ১৯৬০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্কো শহরের এক গানের অনুষ্ঠানে বব ডিলানের পূর্বতন ম্যানেজার কর্তৃক নিমন্ত্রিত হন। তারপর তিনি ডিলানের বাসস্থান বিয়ার্সভিলায় পরিভ্রমন করেন এবং সেখানে ডিলানের সাথে পূর্ণদাসের বেশকিছু গান রেকর্ডিং করা হয়। ডিলানের লেখা গান ‘When the Night Comes Falling from the Sky’ ও ২০১৩ সালে ‘Mr.Tambourine Man’ গানের বাংলা তর্জমা করেন। বাউল গানের জন্য তিনি পৌঁছে যান মিক জ্যাগার, জর্জ হ্যারিসন, মাইকেল জ্যাকসন, জোয়ান বোয়েজের কাছে। বর্তমানে লোকসঙ্গীতের সাথে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহুগানকে মিশিয়ে অর্থাৎ ম্যাশআপ পরিবেশন করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে শিল্পী অনুপম রায়ের কন্ঠে গাওয়া ‘মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষের সনে’ লোকসঙ্গীতে শিল্পী জাভেদ আক্তারের হিন্দি তর্জমা অংশটিও শোনা যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন গানের সুরে কীর্তন গান গাওয়ার রেওয়াজ ইদানিং ভালোই চোখে পড়ে, যা বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক মন্দিরে বহু বিদেশিদের কন্ঠেও শোনা যায়। বাংলার বাইরের, জাপানের কিছু মানুষ এখানে এসে বাংলার লোকগানকে রপ্ত করেছে এবং লোকগানের সুর ও দর্শনকে ভালোবেসে বাংলায় থেকেই তারা সেই গান দিনের পর দিন চর্চা করছে।
মঞ্চকেন্দ্রিক বিনোদনের যুগে লোকসঙ্গীতের যে ভরাডুবি দেখা দিয়েছিল, গণমাধ্যমের প্রসার ঘটার সাথে সাথে তা নতুনভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। সুর ও কথার পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে ইংরেজ আগমনের পর থেকেই। বাংলার লোকসঙ্গীতে প্রকৃতির বড় ভূমিকা ছিল, ভাটিয়ালি গান তার মধ্যে অন্যতম। মূলত লাউয়ের খোল, বেল, মাটি, পিতল ইত্যাদির তৈরি বাদ্যযন্ত্র যেমন-ঢোল, খোল, করতাল, খঞ্জনী, বাঁশি, একতারা, দোতারা সহযোগে লোকগান গাওয়া হত। পরবর্তীতে হারমোনিয়াম, তবলাও ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে লোকসঙ্গীতের প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি গিটার, ইলেকট্রিক বেজ গিটার, কাহন, ড্রামস এমনকি স্প্যানিশ গিটারেও লোকসঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে।
লোকসঙ্গীতের বহিরঙ্গগত বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে মূলত এ যুগেই। তার সাথে পূর্বের তুলনায় লোকসঙ্গীতের শ্রোতা ও শিল্পীর সংখ্যা অনেকাংশেই বেড়েছে। পাশ্চাত্য পোশাকেও যেমন- জিন্সপ্যান্ট ও শার্ট অথবা টপে, লোকসঙ্গীত পরিবেশনে, শিল্পীদের এই অভাবিত পোশাকশৈলীর পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও শিল্পীদের কেশশৈলী অনেকক্ষেত্রেই অপরিবর্তনশীল। যদিও এই বিবর্তনের প্রসঙ্গে শিল্পী ও সমালোচকদের প্রচুরতম বিষয়ে প্রভূততম মতামত রয়েছে। কেউ মনে করছে লোকসঙ্গীতের উন্নতি সাধন হচ্ছে, তো কেউ বা ভাবছে দফারফা চলছে। তবে আমার মতে বাংলার আদি সংস্কৃতির এই নিদর্শন একেবারেই হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে সময়ের ধারাবাহিকতা মেনে আনন্দের সাথে তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সকল ক্ষেত্রেই যে এই পরিবর্তন অসুন্দর তা কখনোই নয়, কিছু সুন্দর তো আছেই। পূর্বেও ছিল, আজও আছে। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের পুরানো ঐতিহ্যর কিছুটা অবশিষ্ট থাকুক তাদের মতো করেই, সময়ের তালে তাল মিলিয়েই।
লোকনৃত্যের ক্ষেত্রে আধুনিকতা আমাদের চোখে খুব সুক্ষ্মভাবেই ধরা পড়ে। কারণ নৃত্যের একটা বড় অংশই হল গান, যা নাচের সাথেই যুক্ত। অর্থাৎ গানের বিবর্তনের সাথে সাথে নাচেরও এক অংশের বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। তাই সেই বিচারেই বলা যায়,নাচও সঙ্গীতের মতোই আধুনিকতার আলোয় আলোকিত।
পূর্বে লোকনৃত্য মূলত নানান ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করেই হত। মধ্যযুগের সাহিত্যেও তার প্রমাণ পাই। কীর্তননাচ, বাউলনাচ, গম্ভীরানাচ, ঝুমুরনাচ, টুসু নাচ, ছৌ-নাচ ইত্যাদি লোকনৃত্য বাংলার ঐতিহ্য। কিন্তু এই লোকসংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার করে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস আজ অনেকাংশেই সার্থকতা লাভ করেছে। ছৌ-নাচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয়ের উদ্যোগে গ্রাম থেকে প্রথমে শহরে এবং পরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচার লাভ করে। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার অন্যতম লোকনৃত্য ‘কালিকাপাতাড়ি’, এই নৃত্যের মাধ্যমে প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনিকে জীবন্ত করে তোলা হয়। কালের নিয়মে এই সংস্কৃতি যখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল, তখন কিছু সচেতন সংস্কৃতজ্ঞ মানুষ সেই শিল্পকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে গণমাধ্যমের সাহায্যে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়ে নতুন করে বাঁচিয়ে রাখার ব্রত গ্রহণ করেন। তবে পোশাক ও সাজসজ্জা নাচের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। সেই দিকের কিছু পরিবর্তন খুব লক্ষনীয়। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের লোকনৃত্যের শিল্পীরা পোশাক ও সাজসজ্জার ব্যাপারে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে প্রতিনিয়ত। প্রকৃতির নানা উপাদানের অলঙ্কার ও সংহত অঞ্চলের মানুষের পোশাক ছাড়াও আধুনিক অলংকরন ও সাজসজ্জাও লোকনৃত্যে ভীষণভাবেই চোখে পড়ে। এছাড়াও নাচের অঙ্গভঙ্গিরও কিছু কিছু পরিবর্তন, পাশ্চাত্য নাচের প্রভাবও লক্ষনীয়।
বিভিন্ন রিয়ালিটি শোগুলোতে আজকাল খুব সচেনতার সাথেই লোকসঙ্গীত ও লোকনৃত্যর ওপরও বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ লোকসংস্কৃতিকে নতুনকরে জাগিয়ে তোলার চেষ্টাই শুধু না, সেইসঙ্গে চলছে এই সব শিল্পকে নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরিক্ষাও। সবচেয়ে বড় বিষয়, মঞ্চ বা গণমাধ্যম যাই হোক না কেন, বর্তমান সময়ে মানুষ লোকসংস্কৃতির এই দিকগুলোতে বেশি ঝুঁকে পড়ছে এবং নতুন প্রজন্মও প্রবল ভাবাবেগের সাথেই তাকে গ্রহণ করছে।
কালের নিয়মে ও সামাজিক প্রক্রিয়ায় লোকশিল্পের অনেক কিছুই আজ বিবর্তিত, বিলুপ্ত ও পরিমার্জিত। উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির উপাদানে বিভিন্ন লোকশিল্প যেমন-পাটের তৈরি শিকা, বেণী, আসন, শোলা দিয়ে তৈরি টোপর, ফুল, মাটির হাড়ি, ফুলদানি, টব, দইয়ের পাত্র, এছাড়াও পটচিত্র, আলপনা, বাঁশের তৈরি নানা মূর্তি, এছাড়াও পাটি, পাখা নকঁশীকাথা ইত্যাদি তৈরি হয়ে আসছে।
উত্তর ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাপনের যুগে বহুদিন ধরেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজনের প্রয়োজন ও সৌখিনতার সাধ পূরণ হয়েছে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ও ধাতুনির্মিত বিভিন্ন সামগ্রীতে। কিন্তু বর্তমানে পরিশীলিত সংস্কৃতির মননশীল ব্যাক্তিবর্গের জীবনযাপনের উপাদান সেইসব ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পেরই অন্তর্ভুক্ত। তাদের ঘর সেজে উঠছে পটচিত্র, মাটির ও বাঁশের তৈরি সামগ্রীতে। নিয়ম মেনেই উৎসবের দিনগুলোতে আলপনায় সেজে ওঠে নগর ও গ্রামের বহু ঘর। পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিস দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য ও শৌখিনতার দ্রব্য হয়ে উঠেছে। খাবারের জন্য মাটির পাত্র, তামার পাত্রও বহুজন আজকাল ব্যবহার করছে সেইসবের গুনগত মানের দিকেই লক্ষ্য রেখে। উদাহরনস্বরূপ বলা যেতে পারে শান্তিনিকেতনের খোয়াইয়ের মেলা। সেখানে দেশ -বিদেশের সকল সংস্কৃতির বহু মানুষ তাদের পছন্দসই জিনিস কেনেন। বর্তমান সময়ের শিল্পধারায় অনেক বেশি প্রাচ্যের আদল লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং বিশ্বায়নের কালে পুরোনো ও নতুনের সখ্যতায় লোকশিল্পও নবজাগরণের প্রভাবে প্রভাবান্বিত।
এতক্ষণ শিল্প ও সাহিত্যের কথাই হল। এবার যে দিকের আলোচনায় আসবো, সেখানে লোকসমাজের সমস্ত সাধারণ মানুষ, তাদের জীবনধারন, সংস্কার, বিশ্বাস ও তার বিবিধ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান, যুক্তি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যে ভূমিকা তাতে নবজাগরণের ভাবসাদৃশ্যই ফুটে উঠেছে।
সংহত অঞ্চলের মানুষরা বহু কুসংস্কারকে লোকাচারের অধীনস্থ করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। আজও সেইসব মন্ত্রগুপ্তি, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, জাদু-ক্রিয়া সংস্কারের নামেই চালিয়ে যাচ্ছে অনেক স্থানে। কিন্তু বিশ্বায়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির কালে যুক্তি, বিচার-বিবেচনা যেভাবে সংহত অঞ্চল অব্দি পৌঁছে গেছে তাতে করে বলাই যায় প্রচলিত লোকাচার ও লোকবিশ্বাস থেকে অন্ধ কুসংস্কার অনেকখানি নির্মূল হয়েছে। বিজ্ঞান ও যুক্তির দ্বারা সবকিছুকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে লোকসমাজের বহু মানুষজন। এ অন্ধকার তো একেবারে কখনোই ঘুচবে না, কিন্তু আধুনিকতার আলো সেখানে পৌঁছেছে। এখন প্রত্যন্ত এলাকার মানুষরাও সাপে কামড়ানো কোনো ব্যক্তিকে ওঝার কাছে না নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসেন এবং এবিষয়ে তারা যথেষ্ট সচেতনও।
প্রযুক্তির দৌলতে বিভিন্ন ধর্মীয় লোকাচার, পূজা, বিবাহ, পালা-পার্বণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন দেখা যায়, তাও আধুনিকতারই নামান্তর। পরিশীলিত সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজেও ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আজও নানা লোকাচার পালিত হয়। বর্তমানে আমার অঞ্চলেই বিবাহ অনুষ্ঠানে নানা লোকাচারের পাশাপাশি রক্তদান শিবিরও বিবাহেরই একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও অন্যান্য লোকাচারের পাশাপাশি বৃক্ষ দেবতাকে পূজা করার উৎসব পালন করা হয়। আজকের পৃথিবীতে যা খুবই কাম্য এবং তা মানবিকতার দৃষ্টান্তসূচক। এই রীতিই হয়তো কালের নিয়মেই একদিন সংস্কৃতিরই অঙ্গ হয়ে উঠবে, পুরানো আর নতুনের এই বন্ধনই আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসারে পরিশীলিত ও গ্রামীণ উভয় সংস্কৃতির মানুষই লোকঔষধকে প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল। যা আমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। যেমন-তুলসী পাতার রস ও মধু, কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, কালোমেঘ পাতা ও অন্যান্য ঔষধি গাছ ইত্যাদির ব্যবহার মানুষ কিছুকাল যাবৎ পুনরায় শুরু করেছে। সম্প্রতি সারাবিশ্ব যখন এক মহামারীর কবলে পড়েছে, তখন সবস্তরের মানুষই এই দুর্যোগের সাথে লড়াইয়ে, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য আবারও সেইসব লোকঔষধ ব্যবহারের দিকে পূর্বের তুলনায় অত্যধিক পরিমানে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
অন্যদিকে আজকের পরিশীলিত সমাজের নারীদের বেশভূষা ও সাজসজ্জায় লোকঅলংকারের একটা নেশা দেখতে পাওয়া যায়। একটা দীর্ঘ সময় ধরে প্লাস্টিক ও ইমিটেসনের গয়না ব্যবহারের প্রচলন ছিল, অবশ্য আজ তা সম্পূর্নভাবে শেষ হয়ে যায়নি ঠিকই, কিন্তু সংহত অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে যে ধরনের শাড়ি ও গয়না পড়ার রেওয়াজ ছিল, যেমন- বাঁশ ও অন্যান্য ধাতুর, মাটির তৈরি সেই সকল গয়নায় সাজতে মেয়েরা আজকাল বেশি পছন্দ করছে। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইদানিং বিভিন্ন বুটিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই সব পোশাক ও অলংকার নিয়ে নানান পরীক্ষামূলক কাজও করে চলেছে। এভাবেই লোকঐতিহ্যকে আধুনিকতার আলোতে ফেলে প্রতিমুহূর্তেই তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সমাজের মননশীল ব্যক্তিত্বরা আর সমাজের সাধারন মানুষের কাছেও তা হয়ে উঠছে অনুকরণযোগ্য।
লোকসংস্কৃতির মধ্যেই আছে বাংলা তথা বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক জীবনের শেকড় আর পরিশীলিত সংস্কৃতি হল তার ডালপালা। সংস্কৃতির মধ্যেই আমাদের জীবনযাপনের ধারা প্রতিফলিত হয়। বর্তমানে বিশ্বায়নের সময়ে ভার্চুয়াল জগতের নির্ভরতায় পরিবর্তিত পরিবেশের সংঘাত এবং সংস্কৃতির সংযোগ ও সঞ্চরনের সাথে সাথে লোকসংস্কৃতির রূপান্তর প্রবনতা তথা পরিবর্তনসাধন একান্তভাবেই অনিবার্য। লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবকে কখনোই উপেক্ষা করা সম্ভব নয় কারণ কালের নিয়মকে আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারবো না। ভালো মন্দের দোলাচলতা তো জীবনের সর্বত্রই বর্তমান। লোকসংস্কৃতির এই নতুন জাগরনের ক্ষেত্রে যতই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকুক না কেন, তার মধ্যে দিয়ে যে বাংলার সার্বিক উন্নতি সাধিত হচ্ছে বা হবে তাকে কখনোই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। পরিবর্তন সংস্কৃতি তথা লোকসংস্কৃতির খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু সাহিত্য ও শিল্প সবক্ষেত্রেই তাকে শুধুমাত্র বিবর্তন নামাঙ্কিত করা বোধহয় ঠিক হবে না।
২০১০ সালে গোয়ায় ৪১তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারপ্রাপ্ত, গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটি কি কেবল বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে লোকসংস্কৃতির বিবর্তনেরই প্রতিচ্ছবি! আমার তো তেমনটা মনে হয়নি। বরং সেই চলচ্চিত্রে কাহিনি উপস্থাপনায় লালন ফকিরের জীবন, কর্ম ও তার উদারপন্থী মানসিকতা, যেখানে সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্নতাকে কাটিয়ে যুক্তি ও মানবতার উচ্চভাব গৃহীত হয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে আবারও আজকের মানুষের ভেতরে নতুন করে মানবতার জাগরন ঘটানোর এক প্রচেষ্টা চলেছে বলেই মনে হয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে যার প্রভাব সত্যিই অনস্বীকার্য।
উনিশ শতকীয় নবজাগরণের ইতিহাসেও সমাজের শিল্পী, সাহিত্যিক তথা মননশীল ব্যক্তিত্বদের সর্বোচ্চ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। আজকের সামাজিক ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির এই নবজাগরণের কেন্দ্রেও দেখেছি মননশীল ব্যক্তিত্বদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। আর সমালোচনার খাতিরেও যদি বলি,তবুও বলবো বর্তমানকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র পুরোনোকে আকড়ে ধরে কখনোই চলা সম্ভব নয়, আর সে চলা যথার্থ ও সুন্দর বলে কখনোই বিবেচিত হবে না। অতএব আমাদের অতীত ও বর্তমানের হাত ধরেই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে। আর বাংলা আজ শুধু বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই,সর্বত্রই যেন তার বিরাট পরিবর্তনের ছোঁয়া। আর এই পরিবর্তনের নামই হয়তো আধুনিকতা। তাই সমস্ত দিক বিচার করে বলতে পারি, বাংলার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে যেভাবে পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে এবং তাকে আধুনিক বিশ্বের তথা বাংলার প্রেক্ষিতে যেভাবে পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে বাংলার লোকসংস্কৃতিতে এক নবজাগরণের ভাবকল্পই প্রতিভাত হয়েছে,যে নবজাগরণের এর সময়পর্ব সুদীর্ঘ ও সুদূর বিস্তৃত।
সহায়ক গ্রন্থ:
1. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: রবীন্দ্র রচনাবলী,তৃতীয় খন্ড,বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ। ৬ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড। কলকাতা ১৭ মাঘ ১৪২২;
2. ড. সত্যবতী গিরি, ড.সমরেশ মজুমদার: প্রবন্ধ সঞ্চয়ন (প্রথম খণ্ড) রত্নাবলী, ৫৫ডি, কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০৯, তৃতীয় সংস্করণ: ১০ জুলাই ২০১৩;
3. ড.বরুণ কুমার চক্রবর্তী: লোক-সংস্কৃতিঃ নানা প্রসঙ্গ, বুক ট্রাস্ট, কলকাতা ৭০০০০৯, প্রথম প্রকাশ: ১৩৮৭।
লেখক:
মধুরিমা কর
গবেষক, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়